Thursday, May 14, 2020

ঠগি - Thuggees | ভারতবর্ষের ইতিহাসে বর্বর এক গোষ্ঠী | ADVUT 365



বলা হয়ে থাকে বাংলা এবং উত্তর ভারতের সবচেয়ে নৃশংস ও ভয়ংকর গোপন খুনিদের দল ছিল ঠগি। এরাই ছিল বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকরতম গোপন খুনিদের দল। জানা যায় বাংলায় তাদের আগমন ঘটে ১২৯০ সালের দিকে। ফিরোজ শাহর ইতিহাস গ্রন্থ হতে জানা যায়, ১২৯০ এর সুলতানী শাসনের সময় প্রায় হাজার খানেক ঠগ ধরা পরে। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে সুলতান তাদের কোনো রকম সাজা না দিয়ে দিল্লীতে ফিরে না আসার শর্তে, অনেকটা আপ্যায়নের সাথে নৌকায় তুলে পাঠিয়ে দেয় ভাটির দেশে- তথা এই বাংলায়। আর তারপর থেকেই বাংলার জলে-স্থলে, মাঠে-ঘাটে ছড়িয়ে পরে এই খুনির দল। বাংলায় ঠগিদের ইতিহাসের সূত্রপাত সম্ভবত এখান থেকেই।

ঠগিরা ব্যবসায়ী, তীর্থযাত্রীর কিংবা সৈন্যের ছদ্মবেশে ভ্রমণ করত। এদেরই লোকজন গোপনে বাজার কিংবা সরাইখানা থেকে পথযাত্রীদের সম্বন্ধে খুঁটিনাটি তথ্য জোগাড় করত। তারপর সুকৌশলে সেই যাত্রীদের সঙ্গে মিশে যেত এবং যাত্রাবিরতিতে হত্যাকাণ্ড ঘটাত। একজন যাত্রীকে খুন করত তিনজনের একটি দল। একজন মাথা ঠেলে দিত, অন্যজন ফাঁস পরাত, আরেকজন পা চেপে ধরত। কেউ পালিয়ে গেলেও রক্ষা ছিল না, কাছে-পিঠেই ওঁত পেতে থাকত ঠগিদের অন্য কোনো দল। ঠগিদের খুনের অস্ত্রটা ছিল বেশ অবাক করার মতো। অতি সাধারণ, কিন্তু সাংঘাতিক কার্যকর। এক ফালি হলদে কাপড়ের টুকরো। দুই ভাঁজে ভাঁজ করলে মাত্র ৩০ ইঞ্চি। ১৮ ইঞ্চির মাথায় একটা গিট। তাতে একটা রুপোর টাকা বা তামার ডবল পয়সা বাঁধা। নিপুণ ঘাতকের হাতে সেটাই হয়ে উঠে অব্যর্থ মরণ ফাঁস। ভৃপ্রকৃতি এবং পরিবহণ ব্যবস্থাভেদে বিভিন্ন অঞ্চলে ঠগিদের কার্যপ্রণালী এবং হত্যা করার ধরণ ভিন্ন ছিল। যেমন বাংলার ঠগিরা প্রধানত নৌপথেই তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করত। নদীর ঠগিরা সাধারণত তাদের হাতে পড়া হতভাগ্যদের মাথা পানিতে চুবিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করত। তবে ঠগিরা সবাইকে হত্যা করত না। যেমন- ভিক্ষুক, সংগীতজ্ঞ, নৃত্যশিল্পী, ঝাড়ুদার, তেল বিক্রেতা, কাঠমিস্ত্রি, কামার, বিকলাঙ্গ, কুষ্ঠরোগী, গঙ্গাজলবাহক ও নারীদের হত্যা নিষেধ ছিল। তবে ব্যবসায়ীদের স্ত্রীদের হত্যা করা হতো।
বছরের সব সময় তারা খুন করত না। এমনিতে তারা সাধারণ গেরস্তের মতোই জীবনযাপন করত। বিশেষ একটা সময়, সাধারণত বর্ষার পর পরই তারা বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যেত। পথিকদের হত্যা করে তাদের সর্বস্ব লুট করে নেয়াই ছিল তাদের জীবিকার মাধ্যম, পেশা। তারা কিন্তু এই হত্যাকে কখনও পাপ হিসেবে দেখেনি, মা ভবানীকে (কালি মা) খুশি করার উদ্দেশ্যে তারা এই হত্যাকে উৎসর্গ করতো।
ঠগিরা দল ভারী করত বংশপরম্পরায়। ঠগির ছেলেকেও সে নিয়ে আসত এই পেশায়। তবে সেটা সাবালক হওয়ার পর। তার আগ পর্যন্ত তাকে দলে রাখা হতো কিন্তু কিছু করতে দেওয়া হতো না।
সব ঠগিদের দলেই একজন দলনেতা বা সর্দার থাকত। দলনেতাকে বলা হতো জমাদার। সবাই তাকে মেনে চলত। শিকার করার পর যা পাওয়া যেত তা সবাই সমানভাগে ভাগ করে নিত। এমনকি দলে কেউ অনুপস্থিত থাকলেও তার ভাগ ঠিকমতো পেয়ে যেত। ঠগিদের প্রধান তীর্থক্ষেত্র ছিল পশ্চিমবাংলার ’কালিঘাট’ ও বিন্ধ্যাচলের ’ভবানী মন্দির’। যদিও ঠগিরা ছিল মূলত কালির উপাসক তবে ঠগিদের মধ্যে মুসলমান লোকও ছিল। আরবে হজ্জ পালনকারীদের পথপ্রদর্শক এর বেশে তারা বাংলার জেলাসমূহে আসত এবং ধনীদের অত্যাবশ্যকীয় হজ্জ পালনে উদ্বুদ্ধ করত। তাদের পরিচালনায় তারা হজ যাত্রা শুরু করলে ঠগীরা তাদের খুন ও তাদের মালামাল লুণ্ঠন করত।
এভাবেই চলছিল তাদের গোপন কীর্তিকলাপ। অবশেষে এই ঠগিদের মূলোৎপাটন হল উইলিয়াম স্লিম্যানের কল্যানে। কাকতালীয়ভাবেই ঠগিদের একটা দলের সন্ধান পেয়ে গিয়েছিলেন এই ইংরেজ রাজকর্মচারী। পরে দেখা যায় কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়েছে। ঠগিদের সম্বন্ধে ব্রিটিশ সরকার প্রথম জানতে পারে ১৮১২ সালে। রাজ্যের নানা স্থানে শ্বাসরোধ করে হত্যা করার সংবাদ ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছায়। কর্তৃপক্ষ প্রথম প্রথম বিষয়টি আমলে নেয়নি, ভেবেছিল বিচ্ছিন্ন ঘটনা। ১৮১২ সালের দিকে গঙ্গার ধারে একটি গণকবরে একত্রে প্রায় ৫০টি মৃতদেহ পাওয়া যায়। গণকবরটি পরীক্ষা করে ব্রিটিশ তদন্ত দল ও কর্তৃপক্ষ অনুমান করে গণহত্যার পেছনে রয়েছে একদল সঙ্গবদ্ধ খুনি। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে ঠগি নামে এক গোষ্ঠীর কথা। ১৯৩৩ সালে উইলিয়াম স্লিম্যানের নাতি জেমস স্লিম্যানের লেখায় জানা যায়, একজন ঠগি মাসে গড়ে ৮-১০ জনকে খুন করত। সে হিসেবে প্রায় ২০ লক্ষেরও অধিক মানুষ এই ঠগিদের শিকার হয়েছিল বলে অনেক বিশেষজ্ঞদের ধারণা, যা অস্বীকার করারও কোনো উপায় নেই। কারণ বাহরাম বলে এক নিষ্ঠুর ঠগির নিজের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ৯৩১ জন মানুষকে সে খুন করেছিল বলে দাবি করে এবং পরবর্তীতে ঐ নাম গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে ওঠে। তৎকালীন বেঙ্গল আর্মি অফিসার কর্নেল উইলিয়াম স্লিম্যান সে সময় ঠগি খুঁজতে গা উজাড় করে দিয়েছিল। ১৮৩০ থেকে ১৮৪১ সালের মধ্যেই প্রায় তিন হাজার ৭০০ ঠগি ধরা পড়ে। তাদের প্রায় সবাইকে পরে ঝুলতে হয় ফাঁসিতে, যে ফাঁস দিয়ে তারা মেরেছিল লাখ লাখ পথিককে।

0 comentários:

Post a Comment

Feature Post