Thursday, April 8, 2021

মঙ্গল গ্রহে পাঠানো পারসিভেরেন্স রোভার নিয়ে এতোটা হৈচৈ কেন বিজ্ঞান-মহলে? সেই বিষয়টা আপনাদের সামনে প্রকাশ করতেই আমার আজকের পর্ব।


নাসা পারসিভেরেন্স এর আগেও আরও ৪-টি সফল রোবটিক মিশন পাঠিয়েছিল মঙ্গলে। সেগুলো ছিল সোজার্নার ( Sojourner), অপুর্চুনিটি (Opportunity), স্পিরিট (Spirit), এবং কিউরিওসিটি (Curiosity)। রোভারগুলি সাফল্যের সংগে চষে বেড়িয়েছে মঙ্গলের মাটি। পৃথিবীতে পাঠিয়েছে বহু ছবি ও তথ্য।


তখন কিন্তু এতটা কৌতূহল না থাকলেও পার্সিভেরান্স এর ক্ষেত্রে কৌতূহল ও আগ্রহ দুটোই লক্ষ করা যাচ্ছে।


কারণটা বেশ আশাব্যঞ্জক।

মঙ্গলে মানুষ পাঠানোর পরিকল্পনা আমেরিকার অনেক আগে থেকেই। নাসার দায়িত্ব সেই পরিকল্পনাকে বাস্তব রুপ দান করা। 


আজ থেকে প্রায় বছর পঞ্চাশেক আগে নাসা জয় করেছে চাঁদ, এক বার নয়, ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সালের মধ্যে ৬-ছয় বার চাঁদে মানুষ পাঠিয়েছে নাসা। প্রতিটি মানুষই চাঁদ গিয়ে আবার আমাদের পৃথিবীতে ফেরত এসেছেন। সর্বমোট ১২-জন এসট্রোনাটস চাঁদে পদার্পন করেছেন। আমেরিকার জন্য সে এক বিরাট সাফল্য। পৃথিবীর অন্য কোন দেশ চাদের মাটিতে মানুষ পাঠানোর সাফল্য অর্জন করতে পারেনি আজ পর্যন্ত। 


চাঁদে বার বার মানুষ পাঠানো বিপুল খরচের ব্যাপার এবং সেখান থেকে পাবার কিছু নেই বিধায় আমেরিকা গত ৫০ বছরে নতুন করে আর কোন মিশন চাঁদে পাঠায়নি। তবে, ভয়েজার-১ ও ভয়েজার-২ এর মতো আগ্রাসী মিশন এখনও অব্যহত আছে তাদের। আমরা জানি ভয়েজারস এখন আমাদের পৃথিবী থেকে প্রায় ২৫ বিলিয়ন মাইল দূরে ছুটে চলছে, দূর থেকে আরও দূরে চলে যাচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে পৃথিবীর সংগে। ভয়েজার মুন মিশনের চেয়েও বেশী সফলতা দেখাতে পারছে।


শনি গ্রহের চাঁদ টাইটানের মাটি স্পর্শ করেছে আমেরিকার হুইগেন্স রোভার - দেখেছে মিথেনের নদী, মিথেনের বৃষ্টি, ঝড়। সেও এক চমকপ্রদ আবিস্কার এবং সাফল্য। ৩ কোটি মাইল দূরবর্তী গ্রহানুর পৃষ্ঠ থেকে চিলের মতো ছৌ মেরে তুলে এনেছে গ্রহানুর মাটি। 


নাসা এই পর্যন্ত ২০০'র উপর মহাকাশ মিশন পরিচালনা করেছে এবং তার মধ্যে সফল মিশন ছিলো ১৩৫টি। নাসা এ পর্যন্ত যতগুলো নভোচারী বাহী মহাকাশ মিশন পাঠিয়েছে তার মধ্যে চ্যালেঞ্জার ও কলম্বিয়া মিশন ২টি ব্যর্থ হয়ে মারা গেছেন ১৪ জন এসট্রোনটস। আর এসব কিছু থেকে নাসা অর্জন করেছে অনেক অনেক অভিজ্ঞতা।


বিশাল অর্থনৈতিক বিষয় জড়িত বিধায় মঙ্গলে মানুষ পাঠানোর বিষয়ে চিন্তা থাকলেও সিদ্ধান্ত নিতে দেরী হচ্ছিল তাদের। অবশেষে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার ক্ষমতাকালে নতুন করে চাঁদে ও মঙ্গলে নভোচারী পাঠানোর সিদ্ধান্ত ও প্রয়োজনী বাজেট বরাদ্দের সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছিলেন। তৈরী করেছেন বিশ্বের প্রথম 'ইউএস স্পেস-ফোর্স'।


ওদিকে বেসরকারী মহাকাশ গবেষক ইলন মাস্ক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি মঙ্গলে একটি শহর তৈরী করবেন, যেখানে মানুষ বসবাস করবে। এছাড়া তিনি আগামী ২০৩০ সালের মধ্যেই মঙ্গলে মানুষ পাঠানোর ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছেন। যেখানে নাসার পরিকল্পনা ২০৪০ সাল নাগাদ। এখন দেখার বিষয় কে আগে সফল হয়। নাসা নাকি স্পেস-এক্স?

মুলত মঙ্গলে মানুষ পাঠানোর প্রথম পদক্ষেপ হিসাবেই এবার নাসা মঙ্গলে পাঠিয়েছে পার্সিভেরান্স রোভরকে। 


রোভারটিকে বেশ কিছু অত্যাধুনিক যন্ত্র দিয়ে সজ্জিত করা রয়েছে।

তার মধ্যে সবচেয়ে আলচিত যন্ত্রটি হলো মোক্সি (MOXIE)। আমরা জানি মঙ্গলে খুবই পাতলা বায়ুমন্ডল রয়েছে। মঙ্গলের বায়ুমন্ডল আমাদের পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের তুলনায় ৯৯ শতাংশ পাতলা। এবং সেই বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাইঅক্সাইড এর পরিমাণ ৯৬%। 


মোক্সির কাজ হচ্ছে মঙ্গলের বায়ুমন্ডল থেকে কার্বন-ডাইঅক্সাইডকে ৮০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ভেংগে তা থেকে অক্সিজেন তৈরি করা। যদি মোক্সিফ এতে সফল হয়, তাহলে নাসা শিগগিরই পর্যাপ্ত অক্সিজেন উৎপাদনের জন্য মঙ্গলে আরও বড় ধরনের মিশন পরিচালনা শুরু করবে এবং সেই তৈরীকৃত অক্সিজেন ব্যবহার করা হবে মঙ্গলের মহাকাশযানের জ্বালানী হিসাবে। প্রচুর পরিমানে অক্সিজেন তৈরী করা হবে মঙ্গল গ্রহে। মানুষ যখন মঙ্গলে যাবে তখন মানুষকে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ করা হবে সেখান থেকেই এবং সেই উৎপাদিত অক্সিজেন আবার মঙ্গলের পরিবেশে উম্মুক্ত করে দেয়া হবে সেখানকার বায়ুমন্ডল পরিবর্তনের লক্ষ্যে। 


মোক্সি এবার পরীক্ষামূলকভাবে ১০ গ্রাম অক্সিজেন উৎপন্ন করে দেখবে আমাদের চিন্তা সঠিক পথে এগুচ্ছে কি না। যার ফলে আমরা খুব শিঘ্রই তার ফলাফল জানতে পারবো। 


এছাড়া রোভারটি যেখানে অবতরণ করেছে, ধারণা করা হচ্ছে, সেখানে একসময় বড় একটি লেক ছিল যা পানিতে পরিপূর্ণ ছিল। এই ধারণাটি সত্য কি না সেটাও যাচাই করার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি রয়েছে রোভারের সংগে, অপেক্ষা শুধুই পরীক্ষার। 


বিজ্ঞানীদের ধারনা, মঙ্গলে মাটির নীচে এখনও বরফে জমাটবদ্ধ পানির অস্তিত্ব রয়েছে। সেটাও যাচাই করে দেখা হবে। আরও দেখা হবে সেই মাটিতে কোটি কোটি বছর আগে সত্যিই কোন প্রাণের অস্তিত্ব ছিলো কি না। বা এখনও কোন এককোষী প্রাণ রয়েছে কি না।


এছাড়া রোভারটি মঙ্গলের মাটি খুঁড়ে মাটির বেশ কিছু স্যাম্পল ৩৮-টি টিউবে সংগ্রহ করে রোভারে স্থাপিত নিজস্ব রকেট দিয়ে পৃথিবীতে পাঠাবে আরও বিস্তারিত গবেষনার জন্য। 


ইতোপূর্বে অপুর্চুনিটি নামের যে রোভারটি মঙ্গলে পাঠানো হয়েছিল সেটা মঙ্গলের ধুলা ঝড়ের কারনে নির্ধারিত সময়ের আগেই পৃথিবীর সংগে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। 


এই ডাষ্ট বা ধুলা ঝড় মঙ্গলের জন্য এক মহাসমস্যা। সেখানে প্রায়ই ধুলা ঝড় বা ডাষ্ট-স্ট্রোম হয়। আর সেজন্যই এবার মেডা (MEDA) নামের একটি ইলেকট্রনিক সেন্সর সংযুক্ত করা হয়েছে পারসিভেরান্স রোভারের মধ্যে। মেডার কাজ হবে পরীক্ষা করে দেখা যে কতটা ডাষ্ট রয়েছে মঙ্গলের আবহাওয়ায়, কিভাবে এটি তৈরী হয় এবং এথেকে মুক্তির উপায় কি হতে পারে। ভবিষ্যতে যখন মানুষ পাঠানো হবে মঙ্গলে তখন যেন এই ডাস্ট থেকে মানুষ রক্ষা পায় সেটা নিয়ে গবেষনা করা। 


এছাড়াও পারসিভেরান্সে রয়েছে ইনজিউনিটি নামের প্রায় ২ কেজি ওজনের একটি হেলিকপ্টার। এই মার্সকপ্টারটিকে উড়ানো হবে মঙ্গলের আকাশে। হেলিকপ্টারটির ব্লেড প্রতি মিনিটে ২৫০০ বার ঘুরবে। আগেই বলেছি মঙ্গলের বায়ুমন্ডল পৃথিবীর তুলনায় ১০০ ভাগের ১ ভাগ মাত্র। সে কারণে সেখানে হেলিকপ্টার উড়ানো একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। আমাদের পৃথিবীর বাইরে এই প্রথম ভিনগ্রহের আকাশে উড়বে হেলিকপ্টার। 


হেলিকপ্টারটি যদি সাফল্যজনকভাবে উড়ানো যায়, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে মঙ্গলের জন্য এরিয়াল মার্স মিশন শুরু হবে। তৈরী করা হবে কমপক্ষে ১ মাইল উড়ে যাওয়া সম্ভব এমন বিমান বা হেলিকপ্টার। ভবিষ্যতের নভোচারীরা সেই হেলিকপ্টারে বা বিমানে উড়ে বেড়াবে মঙ্গলের বায়ুমন্ডলে। 


অর্থাৎ মঙ্গলে মানুষ পাঠানোর পরিকল্পনার জন্য এটি একটি সূদুর প্রসারী এবং দূরদর্শি মার্স মিশন। 


আগামী এক দশকের মধ্যে পৃথিবীর মানুষ নতুন প্লানেটে নতুন ঠিকানা খুঁজে পাবে এমনটাই আশাবাদী আমরা। 


আমরা জানি ১৪৯২ সালের ১২ই অক্টোবর ক্রিষ্টোফার কলম্বাস স্পেন থেকে পশ্চিম দিকে সমুদ্রপথে যাত্রা করে ইন্ডিয়া আবিস্কার করতে গিয়ে আবিস্কার করে ফেলেন দু'টি বিশাল মহাদেশ; যেটাকে বলা হতো 'নতুন পৃথিবী'।


ক্রিষ্টোফার কলম্বাস তার যাত্রা শুরু করেছিলেন ১৪৯২ সালের ৩রা আগষ্ট। 


ভাবুন তো ঠিক সেই সময় স্পেনের রানী তথা স্পেনবাসীর মনের কেমন অবস্থা ছিল যখন সত্যি সত্যিই ভয়ংকর আটলানটিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে অজানার উদ্দেশ্যে নতুন কিছু আবিস্কারের লক্ষ্যে যাত্রা শুরু করেছিলেন কলম্বাস।


মঙ্গল মিশনও আমাদের কাছে তেমনই বিস্ময়কর এবং আশ্চর্যের। শুধুমাত্র ১৩০ মিলিয়ন মাইল দূরত্বের বা ৬ মাসের যাত্রাপথের মঙ্গলের মাটি নয়; আমরা অধীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছি ৫৮৭ আলোকবর্ষ দূরের কেপলার (Kepler-22b) গ্রহে মানুষের অবতরণ দেখতে।


আজ এ পর্যন্তই। পরবর্তীতে আবারও দেখা হচ্ছে সে পর্যন্ত ভাল থাকুন সুস্থ থাকুন ধন্যবাদ।


0 comentários:

Post a Comment

Feature Post