Thursday, July 30, 2020

অসীম ব্রহ্মাণ্ডে আমাদের অস্তিত্ব আসলে কোথায়? Indefinite Destination of V...



অনন্ত মহাশুন্যে আমরা যে কতটা নগন্য তা এই ছবিটি দেখলেই বোঝা যায়। এই ছোট্ট ধূলিকণার সমান বস্তুটিকে দেখলে তাই মনে হয়। বিশাল গাঢ় অন্ধকারের মাঝে এটাই আমাদের পৃথিবী, যেখানে রয়েছে কোটি কোটি মানুষ, আমি আপনি অজস্র জীব-জন্তু, পাহাড়, সাগর-মহাসাগর। এই ছবি মানবসভ্যতাকে আরেকবার মনে করিয়ে দিয়েছিল, মহাজাগতিক পরিমণ্ডলে মানুষের অবস্থান কতটা নগণ্য ও তুচ্ছ। ছবিটি ৬০০ কোটি কিলোমিটার দূর থেকে তুলেছিল মানুষের তৈরি স্পেস্ক্রাফট ভয়েজার-১। যেন শেষ বার ফিরে দেখার মত। স্পেস্ক্রাফটি এখন শুধু পৃথিবী থেকেই দূরে নয় বরং আমাদের সৌরজগৎ কে টাটা বাই বাই জানিয়ে পাড়ি জমিয়েছে অন্ধকারাচ্ছন্ন অসীম তারকামণ্ডলে।

এখন পর্যন্ত মানুষের পাঠানো সবচেয়ে দূরবর্তী মহাকাশযান ভয়েজার ১। ৭২২ কিলোগ্রাম ওজনের এই স্পেসক্রাফটি ১৯৭৭ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর নাসা মহাশূন্যে প্রেরন করেছিল সৌরজগতের বাইরের পরিবেশ সম্পর্কে জানার জন্য। যার ১৫ দিন আগে লঞ্ছ করা হয়েছিল ভয়েজার ২ কে। তবে ভয়েজার ১ এর গতি ও দূরত্ব ভয়েজার ২ অনেক বেশি। ভয়েজার ২ এর অনেক আগেই ভয়েজার ১ সৌরজগতের এস্টেরইড বেল্টকে অতিক্রম করতে পেরেছিল। টানা ৪৩ বছর ছুটে চলেছে মহাশুন্যে আর এটিই প্রথম স্পেস্ক্রাফট যা আমাদের সৌরজগতকে অতিক্রম করেছে। 'লং ডিসটেন্স রিলেশনশিপ'এর সবচেয়ে বড় উদাহারণ হয়ে ভয়েজার-১ এখনো পৃথিবীর মানুষের সাথে যোগাযোগ রক্ষা চলেছে।

একটা দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়ার পর ভয়েজার ১ বৃহষ্পতি গ্রহকে অতিক্রম করে ১৯৭৯ সালে। যাত্রাপথে সে আমাদেরকে পাঠিয়েছিল বৃহষ্পতির ছবি। যে বৃহষ্পতিকে টেলিস্কোপে দেখলে শান্ত মনে হয়, কিন্তু ভয়েজারের পাঠানো ছবিতে আমরা দেখেছি সেখানে শত শত প্রচন্ড হারিকেন বয়ে চলেছে। প্রায় ৩৮০ বছর ধরে বয়ে চলা এক দানবঝড় - দ্যা গ্রেট রেড স্পট। এই ঝড়ের আয়তন তিনটা পৃথিবীর সমান। আর শত শত সক্রিয় আগ্নেয়গিরির সন্ধান মিলেছে বৃহষ্পতির চাঁদ আইওতে। বৃহষ্পতির গ্র্যাভিটিকে অতিক্রম করে আবারও একটা লম্বা যাত্রা করার পর ভয়েজার-১ শনি গ্রহ অতিক্রম করে ১৯৮০ সালে। ভয়েজার আমাদেরকে জানিয়েছে শনিকে প্রদক্ষিণ করছে আরো অনেকগুলো বরফের তৈরী চাঁদ। এছাড়া আমরা শনির আরেকটি বলয় সম্পর্কে জানতে পেরেছি। যা আমরা আগে কখনোই জানতে পরি নি। ইউরেনাস ও নেপচুনকে পর্যবেক্ষণ শেষে ভয়েজার তাঁর সর্বশেষ ছবিটি তুলেছিলো ১৯৯০ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারী। যখন সে আমাদের পৃথিবী থেকে ৬০০ কোটি কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছিল। আর এটাই হল সেই ছবি।

অবশেষে, ২০১২ সালের ১লা আগস্ট ভয়েজার ১ সৌরজগতের শেষ প্রান্ত হেলিওস্ফিয়ার অতিক্রম করে, প্রথমবারের মতো মানব তৈরি কোন স্পেস্ক্রাফট ইন্টারস্টেলার স্পেসে প্রবেশ করে। সে সময় সূর্য থেকে এর দূরত্ব ছিল প্রায় ২২০০ কোটি কিলোমিটার। আলোর গতিতে আমাদের সৌরজগতের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে সময় লাগে প্রায় ১০ ঘণ্টার মত। সেখানে ৩৫ বছর সময় লেগেছে ভয়েজার ১ এর।

এখন আপনি হয়তো ভাবছেন ইন্টারস্টেলার স্পেস কি? সূর্য থেকে বের হওয়া সোলার এনার্জির জন্য আমাদের সৌরজগতের চারপাশে একটা গোলাকার ঢালের মতো তৈরি হয়েছে, এই ঢালের ভেতরে রয়েছে হেলিওস্ফেয়ার আর বাইরে অংশকে বলা হয় ইন্টারস্টেলার মিডিয়াম, এখানে সূর্যের আকর্ষণ বল পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়। এই ঢালই সৌরজগতকে মিল্কি ওয়ে থেকে আসা মহাজাগতিক বিকিরণ থেকে রক্ষা করে।

২০১৫ সালে ভয়েজার-১ সৌরজগতের শেষ সীমান্তে নতুন এক স্তরের সন্ধান পায়। বিজ্ঞানীরা যাকে বলছেন Magnetic Highway। ২০২০ সালের জুলাই পর্যন্ত ভয়েজার-১ প্রতি সেকেন্ডে ১৭ কিলোমিটার গতিতে প্রায় ৪৩ বছর ধরে ছুটে চলেছে এবং এখনো অনন্ত মহাশূন্য থেকে পাঠানো বার্তার মাধ্যমে পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। ভয়েজার-১ থেকে বর্তমানে পৃথিবীতে তথ্য আসতে সময় লাগছে প্রায় ২০ ঘণ্টা। ভয়েজার থেকে পাঠানো সিগন্যাল আমাদের পৃথিবীতে এসে পৌঁছতে অনেক দুর্বল হয়ে যায়। তাই নাসা সারা বিশ্বে অসংখ্য রিসিভার লাগিয়েছে ভয়েজারের সাথে যোগাযোগ ধরে রাখতে। ধারনা করা হচ্ছে আনুমানিক ২০২৫ সালের পর ভয়েজার আমাদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেবে। তার পর হয়তো আমরা আর জানতে পারবো না তার অবস্থান। অনন্তকাল ধরে ছুটে চলবে এই অসীম ব্রহ্মাণ্ডে।

কিন্তু ইন্টারেস্টিং ব্যাপারটা হল, বিজ্ঞানীরা ভয়েজারকে পাঠানোর সময় তাতে জুড়ে দিয়েছিল কপারের তৈরি একটা গ্রামোফোন ডিস্ক। এই ডিস্ক টাকে এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছিল যে, এটা অন্তত ১০০ কোটি বছর পর্যন্ত ঠিকঠাক থাকবে। এখানে রেকর্ড করা আছে, তিমির আওয়াজ থেকে শুরু করে চাক বেরির মিউজিক পর্যন্ত পৃথিবীর নানা ধরনের শব্দ। বিশ্বের ৫৫টি ভাষায় স্বাগত জানানো হয়েছে এখানে, এমনকি আমাদের বাংলা ভাষাও স্থান পেয়েছে সেই ডিস্কে। তবে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল এই ডিস্কে ছিল সবেমাত্র বিয়ের প্রস্তাব পাওয়া এক ২৭ বছর বয়সি তরুণীর আসল প্রেমের ব্রেনওয়েভ! মহাজাগতিক কোন বুদ্ধিমান প্রাণী যদি থেকে থাকে একদিন হয়ত তারা এসব রেকর্ডের কথা ও ধ্বনির মর্মোদ্ধার করতে পারবে।

সে অনেক দীর্ঘ সময়ের কথা। আজ থেকে এক শ কোটি বছর আগে পৃথিবীতে প্রাণের সবচেয়ে জটিল রূপ ছিল স্ট্রোমাটোলাইট নামের এক ধরনের সায়ানো-ব্যাকটেরিয়া। এখন থেকে একশ কোটি বছর পর সূর্য মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে। তখন এটি আকারে বড় হবে এবং এর উজ্জ্বলতা ও তাপ বেড়ে যাবে। সেই তাপে পৃথিবীর সাগর-মহাসাগরের জলরাশি টগবগ করে ফুটবে। তার অনেক আগেই পৃথিবীতে প্রানের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। কিন্তু তখনও ভয়েজার মহাবিশ্বের কোথাও না কোথাও থাকবে। যতদিন সে টিকে থাকবে ততদিন পৃথিবী নামক নীল গ্রহের বুদ্ধিমান প্রানী মানুষের অস্তিত্তের প্রমান বয়ে বেড়াবে।

0 comentários:

Post a Comment

Feature Post