Friday, December 4, 2020

কঙ্কাল উপকূল (নামিবিয়া) | Skeleton Coast - Namibia's "Gates of Hell"

পর্তুগিজ তিমি শিকারী নাবিক জলদস্যুরা জায়গাটির নাম দিয়েছিল গেট অব হেল। আর নামিবিয়ার বুশম্যান গোষ্ঠীর লোকজনের মতে এলাকাটি ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন প্রচন্ড রাগ নিয়ে। কর্কশ কঠোর সেখানকার পরিবেশ প্রকৃতি। ছোটখাটো কিছু প্রাণী সেখানে বেঁচে থাকে কঠিন সংগ্রামের মাধ্যমে। উদ্দাম সাগরপাড়ের মরুময় শুষ্ক এই পরিবেশে আদ্রতার একমাত্র উৎস সামুদ্রিক জলীয়বাষ্প। ছোট ছোট পশুপাখি বিশেষ করে একধরনের শিয়াল সেখানে তৃষ্ণা মেটায় পাথরের গায়ে মিশে থাকা জলীয় বাস্প

গায়ে মেখে।

আকাশ থেকে এই অঞ্চলটি দেখতে অত্যান্ত দৃষ্টিনন্দন মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এখানকার আবহাওয়া অত্যান্ত বৈরী এবং কর্কশ। হিমশীতল দক্ষিন আটলান্টিক মহাসাগরের সবুজাভ পানির ঢেউ বিকট গর্জনে আছড়ে পড়ে নামিবিয়ার অত্যান্ত উত্তপ্ত কালাহারি মরুভূমির এই উপকুলে। কালাহারির এই অংশটা আটলান্টিক মহাসাগরের শীতল বেঙ্গুয়েলা স্রোতের প্রভাবে বছরের বেশিরভাগ সময় ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন থাকে। এই কঙ্কাল উপকূল নামিবিয়ার আটলান্টিক উপকূলের উত্তর অংশ এবং কুনেনি নদী থেকে অ্যাঙ্গোলার দক্ষিণে স্কপ নদী পর্যন্ত বিস্তৃত। অবস্থানের কারণে সেখানকার বাতাস স্থলভাগ থেকে সমুদ্রের দিকে প্রবাহিত হয়। বৃষ্টিপাতের পরিমাণও সেখানে অনেক কম। বছরে মাত্র ১০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে এই অঞ্চলে। সমুদ্রের ঠাণ্ডা বাতাসের কারনে দিনের বেলা বছরে বেশিরভাগ সময় তাপমাত্রা থাকে ২৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে। আর রাতে তাপমাত্রা নেমে আসে প্রায় ৫ থেকে -১২ ডিগ্রির কোঠায়। কিন্তু কালাহারির ভেতরের অংশের তাপমাত্রা উঠে যায় প্রায় ৫০ ডিগ্রির কোঠায়। কঙ্কাল উপকূল বসবাসের জন্য চরম অনুপযোগী। খুব কম সংখ্যক প্রাণী সেখানে বেঁচে থাকতে পারে। এখানে বেবুন, জিরাফ, সিংহ, হাতি, কালো গণ্ডার প্রভৃতি প্রাণী এই আবহাওয়ার সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে। সমুদ্রের ঢেউ এবং পানির বৈশিষ্ট্যের কারণে এই উপকূলের পানিতে ভারী ফেনা জমে। ইঞ্জিনচালিত জাহাজ এবং নৌকা বর্তমানে এই উপকূলে চলাচল করতে পারলেও আগের দিনে এটা সম্ভব ছিল না। সেই সময় কোনো জাহাজ বা নৌকা ভুলক্রমে কঙ্কাল উপকূলে প্রবেশ করলেও তীর থেকে যাত্রা করা অসম্ভব ছিল। জাহজের যাত্রীদের উপকূল থেকে বের হওয়ার একমাত্র উপায় ছিল কয়েকশ মাইল দীর্ঘ জলাভূমি এবং উষ্ণ মরুভূমি পেরিয়ে যাওয়া। ভুল করে যেসব জাহাজ কঙ্কাল উপকূলে প্রবেশ করত সেসব জাহাজের নাবিকদের মৃত্যু অনিবার্য ছিল। উপকূলের বেশিরভাগ স্থান বালি দ্বারা আচ্ছাদিত। কিছু কিছু স্থানে পাথর আছে। দক্ষিণ অংশ কাঁকর সমভূমি নিয়ে গঠিত এবং টেরেস বে এর উত্তরাংশে উঁচু বালির টিলা লক্ষ্য করা যায়।

স্থানটির নাম কঙ্কাল উপকূল হওয়ার মূল কারণ এখানে প্রচুর তিমি এবং সিলের হাড় পড়ে থাকত। বহু আগে এখানে তিমি শিকার করা হলেও সপ্তদশ শতাব্দীতে সংঘবদ্ধভাবে জাহাজ বহরের মাধ্যমে শিল্প ক্ষেত্রে তিমি শিকারের প্রচলন ঘটে। মাংস এবং চর্বির জন্য তিমি শিকার করা হত এই অঞ্চলে। শতাব্দীকালধরে নির্বিচারে হত্যা করা তিমির কঙ্কাল, সিলের কঙ্কাল, সামুদ্রিক কচ্ছপের খোলসের নিদর্শন এখনও বিদ্যমান কঙ্কাল উপকূলে। এসব ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কঙ্কালের পাশে দেখা মেলে ডুবে যাওয়া জাহাজের ধ্বংসাবশেষ। তিমি শিকারের লোভে এই অঞ্চলে এসে বহু জাহাজ আটকা পড়েছিল এই উপকূলে। পালতোলা জাহাজের আমলে ভয়ানক সাগর টপকে এই উপকূলে আসা গেলেও পাড়ে ভেড়া ছিল প্রায় অসম্ভব। এই উত্তপ্ত মরুভুমিতে স্বাভাবিকভাবে মানুষের টিকে থাকাও ছিল একেবারেই অসম্ভব। দুর্ঘটনা বশত এই অঞ্চলে একবার প্রবেশ করলে আর বের হবার সহজ রাস্তা ছিল না। আর তাই আটলান্টিকের হিমশীতল নোনা পানি আর কালাহারির উত্তপ্ত বালিতে চিরদিনের জন্য সমাধিস্ত হয়ে যেত জাহাজের নাবিকেরা।

আর তাই দুঃসাহসী-বেপরোয়া স্বভাবের পর্তুগিজ নাবিক-জলদস্যুরাও সমীহ করে এ জায়গার নাম দিয়েছিল দোজখের দ্বার বা নরকের দরজা। স্থানীয় বুশম্যানরাও একইভাবে মনে করতো যে, অমন সৃষ্টিছাড়া রুক্ষ পরিবেশের স্থান সৃষ্টিকর্তা একমাত্র রেগে থাকা অবস্থায়ই সৃষ্টি করতে পারেন। দুনিয়ার অন্যসব সৈকত এলাকা থেকে এখানকার পরিবেশ ও প্রাকৃতি রুক্ষ হলেও বৈচিত্রময়। জনশূন্য হওয়া সত্ত্বেও বৈচিত্রময় এই এলাকাটির অবস্থান উত্তর-পশ্চিম নামিবিয়া থেকে অ্যাঙ্গোলা সীমান্ত পর্যন্ত সমুদ্রোপকূল জুড়ে ৫০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। ২০ লাখ হেক্টর বিশাল বালিয়াড়ি আর নূড়ি-কঙ্করময় মরুঅঞ্চল জুড়ে স্কেলিটন কোস্ট এক অদ্ভূত এলাকা।

মরু ঝড়ের কারনে বিশাল বিশাল সব বালির পাহাড় হঠাৎ প্রবল বাতাসের দমকায় হারিয়ে যায়, আবার উদয় হয় কয়েক মাইল দূরের অন্য কোনও সমতলে। বেশ কয়েকটি নদী বিধৌত এই এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে একটি ন্যাশনাল পার্ক। কঙ্কাল উপকূলের দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে বয়ে গেছে উগাব ও হোয়ানিব নদী আর উত্তরে হোয়ানিব ও কুনিনি। দুর্গম হওয়ার কারনে সেখান বেড়াতে যাওয়ার অনুমতি মেলে খুবই কম। বিশেষ করে এলাকাটির উত্তরাংশে পর্যটকদের অনুমতি মেলে কদাচিৎ। আর তাই সারাবছর সেখানে ঘুরতে যাওয়া ভাগ্যবানের সংখ্যা সর্বসাকুল্যে ৮শ জনের মত। এলাকার নির্জন, বন্য, মরুময় আর একইসঙ্গে ভঙ্গুর প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণের স্বার্থেই এই কড়াকড়ি।

উত্তরাংশের কঙ্কাল উপকূল ভ্রমনের জন্য পর্যটকদের ব্যক্তিপর্যায়ে আবেদন করতে হয় নাবিবিয়া সরকারের কাছে। যদিও অনুমতি মেলে সামান্য কিছু পর্যটকদের। কঙ্কাল উপকূলের উত্তরাংশে বেড়ানোর নিরাপদ আর সহজ সুযোগ নিতে হলে আপনাকে ধরতে হবে আকাশপথের সাফারি ট্রিপ, যদিও বেশ ব্যয়বহুল। সাধারণত ৪ দিনের জন্য পরিকল্পিত এ ধরনের সাফারিতে জনপ্রতি গুণতে হয় ৯ থেকে ১২ হাজার মার্কিন ডলার। ছোট বিমানে করে পর্যটকদের নিয়ে নামানো হয় ২০০ কিলোমিটার ভেতরের এয়ারস্ট্রিপে। তারপর সেখান থেকে ল্যান্ডরোভার গাড়িতে করে শুরু হয় উদ্দাম আর বন্য এক মরুযাত্রা। যাত্রাপথে চোখে পড়বে শেয়াল, গিরগিটি, পোকামাকড়, পাখি, কখনোবা মরু হাতি। হাজারে হাজারে সিলের খুলি, সামুদ্রিক কচ্ছপের খোলস আর বিশালাকার তিমির অস্থিসন্ধি-কঙ্কাল জড়াজরি করে পড়ে আছে। প্রবল বাতাসের বেগ আপনার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই ঠেলে নিয়ে যাবে। এই সকল বিষয়গুলো ভৌতিক এক আবহ এনে দেয় দিন-দুপুরেই। সেই মুহূর্তে দেখা মিলতে পারে মানুষের কঙ্কালও। হাজার হাজার জাহাজের শেষ ঠিকানা হয়েছে এই কঙ্কাল উপকুল। সেইসব জাহাজের দুর্ভাগা যাত্রীদের কেউই জীবিত ফিরতে পারে নি। সেইসব কঙ্কালগুলোও এখানে মিলে মিশে একাকার হয়ে আছে।

অনেক নামিদামি জাহাজের শেষ শয্যা হয়েছে এই কঙ্কাল উপকূলে। এর মধ্যে অন্যতম বৃটিশ লাইনার ডুনেডিন স্টার। ১৯৪০ সালে প্রবাল প্রাচীরে আঘাত লেগে তার শেষ ঠিকানা হয় এখানে। ডুনেডিন স্টারকে উদ্ধারে যাওয়া স্যার চার্লস এলিয়ট নামের টাগবোটটিও একই পরিণতির শিকার হয়। নরকের দ্বার হিসেবে কুখ্যাত কঙ্কাল উপকূলে এসে ডুবে যায় চার্লস এলিয়ট। এখানে দেখা যাবে তিমির হাড় দিয়ে তৈরি একটি খিলান দিয়ে চিহ্নিত করা ঐ টাগবোটের দুই নাবিকের সমাধি। তাদের নেতৃত্বেই টাগবোটটি ছুটে গিয়েছিল ডুনেডিনকে উদ্ধার করতে। জেগে থাকা সেই টাগবোটের ধ্বংসাবশেষ এখনও দেখা যায়। এছাড়াও ডুবে যাওয়া জাহাজের তালিকায় আছে এডুয়ার্ড বোলেন, ওটাভি, টোং ট প্রভৃতি।

0 comentários:

Post a Comment

Feature Post